গিরিশ মজুমদার, শিলিগুড়ি, ১৮ ফেব্রুয়ারি:
দুনিয়ার সেরা বন আমাজন নাকি প্রাকৃতিক নয়। মানুষের হাতে তৈরি। এটা অসম্ভবও কিছু নয়। ধরা যেতে পারে ভারতের জঙ্গল-মানব যাদব পায়েং–এর কথা। তিনি দ্যা ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া নামে পরিচিত। পায়েং অসমের জোরাটের কোকিলামুখ গ্রামের বাসিন্দা। তার প্রচেষ্টার ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে ৫০০ হেক্টর বালুতটকে পুনরায় জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। মানুষের হাতে তৈরি এমন এক জঙ্গল সেখানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, কয়েকশো হরিণ, বন্য আরও বহু ধরণের জন্তু রয়েছে। লাখো পাখির বাসস্থান সেখানে। নিয়মিত গণ্ডার এবং হাতির পালের দেখাও মেলে সেই জঙ্গলে। বন তৈরির নেশায় সিয়েরা দ্য মান্টিকুয়েরা পাহাড়ি এলাকায় ১৯৭৩ সালে ৭৭ একর পতিত জমি কিনেছিলেন আন্তোনিওর। ৪০ বছর ধরে সেখানে প্রায় ৫০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন। আজ সেখানে বিশাল অরণ্য হয়ে উঠেছে। নিজের হাতে গড়া এই সবুজ অরণ্যই আন্তোনিওর ঘর-সংসার। ফুলবাড়িতে এমনই এক জঙ্গল গড়ে যেতে চাইছেন পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব। মঙ্গলবার তিনি রাধাবাড়িতে প্রস্তাবিত সেই জায়গা ঘুরে দেখে এমন স্বপ্নের কথা জানান।
ফুলবাড়ির রাধাবাড়িতে বিস্তীর্ণ সরকারি পতিত জমি রয়েছে। সেই জমিতে এবার তৈরি হতে চলছে বনাঞ্চল। এই সবুজায়নে রাজ্য সরকার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অতি দ্রুত বনায়নের জন্য এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে জাপানের মিয়াওয়াকি পদ্ধতি। বিশ্ববিখ্যাত উদ্ভিদবিশারদ, জাপানের মিয়াওয়াকি আকিরা পরিবেশ রক্ষার কাজে নতুন অরণ্য গড়ে সারাবিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন। তাঁর দেখানো পদ্ধতিই মিয়াওয়াকি পদ্ধতি। এতে স্বল্প জায়গায় বেশি সংখ্যক চারা গাছ লাগানো সম্ভব। এই সব গাছ ২-৩ বছরেই বেড়ে উঠে এলাকায় গভীর বনভূমি তৈরি করে। রাজ্যে এটি দ্বিতীয় বড় প্রকল্প। ইতিমধ্যে প্রথম পাইলট প্রজেক্ট করা হয়েছে হাওড়ার শ্যামপুরে। সেখানে কৃত্রিম উপায়ে জঙ্গল তৈরি করা হচ্ছে। ঠিক একইভাবে উত্তরবঙ্গে প্রথম পাইলট প্রজেক্ট হচ্ছে শিলিগুড়ির কাছে রাধাবাড়িতে। একদিকে জোড়াপানি নদী অন্যদিকে তিস্তা সেচখাল। অদূরেই শিলিগুড়ি–জলপাইগুড়ি সড়ক। তার মাঝেই পরিত্যক্ত খাস জমি বেদখলের চেষ্টা হচ্ছিল। সেখানে প্রথম পর্যায় ২৭ বিঘা জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। সামাজিক বনসৃজন বিভাগ এখানে গাছ দেবে। প্রকল্পে সহায়তা করবে উদ্যান ও কানন বিভাগ। বিষয়টি তদারকি করবে ফুলবাড়ি–২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে কাজ করানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন চাওয়া হবে। পর্যটন দপ্তর থেকে পুরো এলাকাটি ঘেরা দেওয়া হবে। মঙ্গলবার ওই এলাকায় ঘুরে দেখেন পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি বলেন, ‘মানুষ জঙ্গল কাটছে। আর আমরা এখানে বনভূমি বানাচ্ছি। এখানে লাখো গাছের মধ্যে একদিকে পলাশ, মহুয়া সেইসঙ্গে কৃষ্ণচূড়া গাছের জোন করা হবে। শিশু, সেগুন, শাল, আম, কাঁঠাল, কাজু, আমলকি, রিঠা, নিম, বেল ইত্যাদি গাছে ছেয়ে যাবে এলাকা। এই বনভূমি দেখতে এলাকায় মানুষজন ঘুরতে আসবেন।’ কয়েকদিনের মধ্যে এখানে কাজ শুরু হয়ে যাবে। এদিন তাই ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তর, ব্লক প্রশাসনের কর্তারা এখানে ছিলেন। উদ্যান পালন বিভাগের ডিএফ ও অ্যাঞ্জেলা ভুটিয়া, উদ্যান ও কানন বিভাগের ডিএফও অঞ্জন গুহ, অতিরিক্ত জেলাশাসক সাধারণ সুনীল কুমার আগরওয়াল এলাকা দেখে যান। মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে একই জমিতে অনেকগুলি স্তরের গাছ তৈরি করা সম্ভব হয়। প্রতিটা গাছ পরস্পরের সঙ্গে অনেকটা বেশি ঘেঁষে থাকে। এতে অনেক কম জায়গায় তুলনামূলক বেশি সংখ্যাতেও গাছ লাগানো যায়। গাছগুলি এমন ভাবে লাগানো হয়, যাতে খানিকটা বেড়ে উঠলেই মাটি পর্যন্ত সূর্যরশ্মি পৌঁছয় না। এর ফলে মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকে। সেই কারণে নিয়মিত গাছে জল দেওয়ার পরিশ্রম কমে যায়। এ ছাড়াও গাছগুলি এমন ভাবেই লাগানো হয়, যাতে সূর্যরশ্মি সরাসরি ওপর থেকেই পড়ে। ফলে গাছগুলির লম্বায় যত দ্রুত এবং বেশি বড় হয়, চওড়ায় তত হয় না। সব মিলিয়ে কম জায়গায় বেশি গাছ তৈরি করা যায়। এই মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য বিভিন্ন জেলার নারেগা প্রকল্পের কাজে নিযুক্ত সরকারি আধিকারিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ চলছে। রাজ্যের ভাবনা আগামী দিনে শহরাঞ্চলেও এই ধরনের কৃত্রিম জঙ্গল তৈরি হবে। যাতে বাতাসে অক্সিজেনের জোগান বাড়ানো যায়। শোনা যায় আমাজন জঙ্গলও নাকি মানুষের হাতে তৈরি। যেখানে কোটি কোটি প্রাজাতির গাছ, বন্য জীবজন্তু রয়েছে। রাধাবাড়ির এই বনাঞ্চলে অন্তত হাজার পাখির আবাসভূমি হয়ে ওঠে তার জন্য আলো ও শব্দবিহীন এলাকা করা হবে সেখানে। পরিবেশ রক্ষা আর জমি রক্ষা। দুই উদ্যোগ একসাথে এবার উত্তরবঙ্গের ফুলবাড়িতে।