শিলিগুড়ি, ২৪ ফেব্রুয়ারি: বিশাল দেহের স্তন্যপায়ী প্রাণীটির নাম হাতি। অত্যন্ত উপকারী তৃণভোজী স্থলচর। হাতি বাহন, বিনোদন ও উপার্জনের মাধ্যম। এদের দাঁত, হার, মাংস ও চামড়া অত্যন্ত দামি বস্তু। তাই প্রচলিত হয়েছে হাতি মরলেও লাখ টাকা। কালো, ধূসর-ফ্যাকাসে ছাড়াও হাতি সাদা বর্ণের হয়। এ বিশাল জন্তু মানুষের অধীন হয়। মানুষ ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে। তারপরও হাতি হিংস্র হয়। হাতির কিছু স্বভাব নিয়ে চিন্তায় পড়তে হয়।
সদ্য শিলিগুড়ির কাছে গজলডোবায় এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে আছড়ে মারে হাতি । পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল অর্জুন কুমার দাস। সময় বাবার বাইক থেকে টেনে নামিয়ে মেরে ফেলে ওকে। এই ঘটনায় এক দিকে মর্মাহত। তেমনি উঠে এসেছে হাতি নিয়ে নানা প্রশ্ন।
হাতি খুব শান্ত স্বভাবের প্রাণী। বেশ নিরীহও বটে। তাকে আঘাত না করলে সেও কাউকে সহজে আক্রমণ করে না। তবে ক্ষেপে গেলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। আক্রমণ করার সময় সে কখনো পিছিয়ে পড়ে না। এদের মধ্যে বুনো হাতি সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। শুঁড় দিয়ে মানুষকে আছাড় দেয়। পদদলিত করে। গাছপালা উপড়ে ফেলে। বাড়িঘর ভেঙে ফেলে। তখন মানুষের ভয়ে পালানো বা অসহায়ের মতো চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। এদের সঙ্গে শত্রুতা করলে নিষ্কৃতি পাওয়া মুশকিল।
হাতির স্মৃতিশক্তিও প্রখর। অনেক বছর আগের ঘটনাও এদের মনে থাকে। মানুষের মতো হাতিরও রয়েছে সংবেদনশীল মন। তাই দুঃখ পেলে এদের চোখেও জল আসে। এদের বুদ্ধির কাছে কোনো বন্যপ্রাণী টেক্কা দিতে পারে না। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, আবহাওয়া সম্পর্কিত জ্ঞানেও হাতির রয়েছে সমান দক্ষতা। প্রায় দেড়শ’ মাইল দূরে থাকা ঝড়ের খবর সবার আগে টের পায় হাতি। হাতির তার বড় বড় কানে খুব নিচু ফ্রিকোয়েন্সিও শুনতে পায়। ফলে ২৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের ঝড়-বৃষ্টির উপস্থিতি টের পেয়ে থাকে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য হাতিকে আমব্রেলা স্পিসিসও বলা হয়। একটি হাতি বনে ছাতার মতো কাজ করে। হাতি টিকে থাকলে বনও টিকে থাকবে। বন টিকে থাকার অর্থই হলো হাজারো জীববৈচিত্র্যের জীবন বেঁচে যাওয়া। এক হাতির মৃত্যুতে অন্যরা নির্বাক দাঁড়িয়ে শোকও পালন করে। এমনকী শুঁড় দিয়ে সেই মরা হাতিকে স্পর্শও করে। মাঝে মাঝে সঙ্গীর মৃতদেহ নিজেরাই বয়ে নিয়ে যায়।
বিশ্বখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানী ইয়েন ডগলাস হ্যামিলটন হাতির ওপর গবেষণার বিবরণে হাতির স্মরণশক্তির বিষয়ে কিছু ধারণা দেন।
তিনি যেসব বুনো হাতি নিয়ে কাজ করতেন তারা হয়তো কখনও তেড়ে গিয়ে মানুষকে আহত করেছে,। কিন্তু হ্যামিলটনের সঙ্গে তাদের ঠিকই বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদের সঙ্গে তিনি ছবি তুলছেন। হ্যামিলটন যখন বিয়ে করলেন তখন তার স্ত্রীকে নিয়ে ওই হাতির সঙ্গে ছবি তুলেছেন। পরে যখন তাদের সন্তান হলো তাদের সঙ্গেও ছবি তোলা হয়েছে। স্ত্রী ও সন্তানরা যে ডগলাস হ্যামিলটনের পরিবারেরই সদস্য হাতিরা সেটাও বুঝতে পারছে।
হাতির পারিবারিক বন্ধনের উদাহরণ হতে পারে কেনিয়ার একটি ঘটনা। সেদেশের ন্যাশনাল পার্কে শিকারিরা হাতির একটি পরিবারের দুজন সদস্যকে গুলি করলে একটি মারা যায় এবং অন্যটি গুলিবিদ্ধ হয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
অন্য হাতিরা তখন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা ওকে সোজা দাঁড় করিয়ে রাখতে সাহায্য করে। কিছুক্ষণ পর হাতিটি মাটিতে পড়ে যায়। তখন ওই হাতির মা ও তার আরো কয়েক সহযোগী মিলে তাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। এটা করতে গিয়ে মায়ের একটি দাঁতও ভেঙে যায়।
অন্য হাতিরা তখন আশেপাশের এলাকা থেকে ঘাস লতাপাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। তারা মনে করে এসব খাওয়ালে হয়তো মৃত হাতিটি জীবন ফিরে পাবে।
এখানেই শেষ নয়। হাতিটি মারা যাওয়ার পর তারা সবাই মিলে তাকে সমাহিত করে। সমাহিত করে ওরা সেখানে রাত কাটায় এবং পরদিন সেখান থেকে চলে যায়। মা হাতিটি যায় সবার পরে।
এমন ঘটনা উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স তরাইতে বেশ কয়েকটি হয়েছে। নকশালবাড়ির অদূরে অল্প কদিন আগেই মৃত্যু হাতির সন্তানকে দেহ সমাধি করতে সমস্যায় পড়তে হয়। মৃত হাতির শাবকটিকে ঘিরে রাখে অন্যান্য হাতিরা। এমনও হয়েছে গর্ত থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে শাবকটিকে।
হাতির শুঁড়ের রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। এদের শুঁড় প্রায় দুই মিটার লম্বা হয়। ওজন হতে পারে প্রায় দেড়শ’ কেজি পর্যন্ত। ওজন হলেও হাতি সাঁতার কাটতে পারে। গভীর জলে শ্বাস নেয়ার জন্য শুঁড় ব্যবহার করে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, হাতির শুঁড়ে প্রায় এক লাখ পেশী আছে, হাড় নেই। তাই হাতি শুঁড়কে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে যেভাবে খুশি কাজ করতে পারে। শুঁড় দিয়েই সে আহার নিজের মুখে তুলে নেয়। শুঁড়-স্পর্শেই কোনো বস্তুর আকার-আকৃতি বা বৈচিত্র্য বুঝতে পারে।
হাতি সাধারণত ৩০ ফুটের মতো উঁচু হয়। ওজন ৩ থেকে ৫ টন। বাঁচে ৬০ থেকে ৭০ বছর। হাতির চামড়া পুুরু, ঝুলঝুল ও হালকা লোমশ। চোখ ছোট হলেও দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ। ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তি প্রবল। লেজ খাটো, আগায় একগুচ্ছ শক্ত চুল আছে। হাতির গর্ভকাল প্রায় দু’বছরের মতো, তথা ২২ মাস। প্রায় দুই থেকে চার বছর পর বাচ্চা দেয়। মাত্র একটি বাচ্চা প্রসব করে। যমজ হঠাৎ জন্মে। এদের প্রজননকাল মার্চ থেকে জুন। নবজাতক প্রায় ০.৯ মিটার লম্বা হয়। ওজন হয় প্রায় ৯০ কেজি, দ্রুত বাড়ে।
হাতির দাঁত খুব দামি হওয়ায় শিকারীদের কবলে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য হাতি। এক্ষেত্রে গর্ভবতী হাতিও বাদ যাচ্ছে না। ফলে পৃথিবীর বুক থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে হাতি। এমনকি ‘হাতির দেশ’ থাইল্যান্ডেও হাতি দুর্লভ প্রাণিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বাসস্থান ধ্বংস, বন উজাড়, জনসংখ্যার চাপ, খাদ্য ও সংরক্ষণের অভাবে হাতি বিলুপ্তির পথে। জঙ্গলে খাবারের অভাব। অভিযোগ রয়েছে হাতির খাবারের যোগান দিতে জঙ্গলের ভেতরে কোনও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। তাই হাতি চলে আসছে জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জঙ্গলের আশেপাশের গ্রামে শুধু নয়, শহরেও চলে আসছে। মাঝে মধ্যে শিলিগুড়ি শহরেও হাতি চলে আসছে। এটা আরও উদ্বেগের চিন্তার। তাই এ জন্তুটির প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত।
©G.Majumder
ছবি সৌজন্যে: প্রবীর বর্মন।
তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা, নয়া শতাব্দী, এস এস